দেশীয় ও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের যে কয়টি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে তার মধ্যে অন্যতম বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। উচ্চ প্রযুক্তি ও বিশেষায়িত পাঁচ শতাধিক ওষুধ প্রস্তুত করছে দেশীয় এ প্রতিষ্ঠানটি। ওষুধ রফতানিতে সমৃদ্ধির সম্ভাবনা, সীমাবদ্ধতা, নীতি ও পর্ববেক্ষণ নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ
রফতানিতে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প কতটুকু অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে?
আমরা যদি পরিসংখ্যান দেখি, তাহলে দেখা যায় বাংলাদেশের ওষুধ ১৬০টার বেশি দেশে রফতানি হচ্ছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেকে দেশেই অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু মোট রফতানি মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলার। এটাতে অনেকেই আবার আশ্চর্য হন। ১৬০টা দেশে রফতানি করলেও টাকার অংকে সেটি মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলার। তবে বাংলাদেশ যে ভালোমানের ওষুধ তৈরি করতে পারে সেটি আমরা বিশ্ববাজারে প্রমাণ করতে পেরেছি। সামনে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। এখন যদি বলেন, ওষুধ শিল্পকে আমরা কতটুকু বিস্তৃত করতে পেরেছি? সেখান থেকে আমরা সফল বলতি পারি।
প্রতি বছরেই রফতানির আকার বাড়ছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের হিসাবে, গত বছর টাকার অংকে এটি সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। তাহলে আমরা কি আন্তর্জাতিক বাজারে আস্থা অর্জন করতে পারছি?
আমরা রফতানির তথ্য মূলত রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) কাছ থেকেই নিই। তাদের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর শেষে আমাদের রফতানি গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার। এশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের বড় কোনো বাজার দেখতে গেলে দেখা যায়, আমাদের টোটাল ভ্যালু চোখে পড়ার মতো নয়। এখন থেকে ১০ বছর আগেও আমাদের রফতানি ছিল ৪০-৪২ মিলিয়ন ডলার। এ সময়টায় আমাদের চার-পাঁচ গুণ বেড়েছে। এটি কিন্তু রাতারাতি হয়নি। ওষুধ অন্য পণ্যের মতো নয়, আমি ভাবলাম একটি পণ্য বানাব আর রফতানি করব। এটি যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রেই সহজ। তবে ওষুধের ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন নয়। ওষুধ শিল্পকে অনেক ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিশ্বের বড় কোনো বাজারে যদি আমরা একটি ওষুধ নিয়ে যেতে চাই, তাহলে পাঁচ-সাত বছর সময় লেগে যায়। আমি যদি একটি পণ্য (ফার্মাসিউটিক্যালস) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে পণ্য ভেদে এটি তিন-সাত বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
দেশের ওষুধ রফতানিকারক কোম্পানিগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে উন্নত ও আধুনিক ওষুধ সরবরাহ করা প্রতিষ্ঠানটি ‘বেক্সিমকো ফার্মা’ নামেই সমধিক পরিচিত। বর্তমানে তাদের ৫০০-এর অধিক ক্যাটাগরির ওষুধ রয়েছে। উৎপাদনের সব পর্যায়ে বজায় রাখা হয় বৈশ্বিক মানদণ্ড। শতভাগ মান নিশ্চিত করে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করে। সংগত কারণেই আস্থা অর্জনের পাশাপাশি সব শ্রেণীর মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পরিণত হয়েছে সফল ফার্মাসিউটিক্যালসে।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ ও ব্রাজিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হয় তাদের ওষুধ। ১৯৭৬ সালে উৎপাদনে আসে বেক্সিমকো ফার্মা। মাত্র চার বছরের মধ্যে ১৯৮০ সালে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ওষুধ তৈরি শুরু করে। নিজস্ব ফরমুলেশন ব্র্যান্ড চালু করে ১৯৮৩ সালে। ১৯৯২ সালে ওষুধের উপকরণ (এপিআই) প্রস্তুত শুরু করে। প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০০৩ সালে অ্যান্টি-রিট্রোভাইরাল (এআরভি) ওষুধ উৎপাদন শুরু করে। ২০০৫ সালে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের (এলএসই) অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট মার্কেটে (এআইএম) তালিকাভুক্ত হয়। চালু করে ক্লোরোফ্লোরো কার্বনমুক্ত এইচএফএ ইনহেলার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) মেনে চলা হয় বেক্সিমকো ফার্মায়। অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের বিভিন্ন মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার স্বীকৃতি অর্জন করে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জিসিসিভুক্ত দেশ, ব্রাজিল, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের কয়েকটি দেশ। ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার থেরাপিউটিক গুডস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (টিজিএ) জিএমপি অ্যাক্রেডিটেশন সার্টিফিকেট পায়। একই বছরে জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর গালফ সেন্ট্রাল কমিটি ফর ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অ্যাক্রেডিটেশনও অর্জন করে। পরের বছর ব্রাজিলের জিএমপি অনুমোদন পায়। ২০১১ সালে অস্ট্রিয়ার জিএমপি অ্যাক্রেডিটেশন পায়। প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২০১২ সালে সিঙ্গাপুরে সালবিউটামল এইচএফএ ইনহেলার রফতানি করে।
২০১৩ সালে ইউরোপের বাজারে চক্ষুসংক্রান্ত পণ্য রফতানি শুরু করে এবং ২০১৪ সালে তাইওয়ানের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (টিএফডিএ) ও হেলথ কানাডার জিএমপি অনুমোদন লাভ করে। ওই বছর অস্ট্রেলিয়া ও রোমানিয়ায় ওষুধ রফতানি শুরু হয় তাদের। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) জিএমপি অনুমোদন পায়। ওই সময় কুয়েতের বাজারে প্রবেশ করে তারা।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে মালয়েশিয়ার বায়োকেয়ার ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ওষুধ তৈরির কারখানা স্থাপন করে। বাংলাদেশের বাইরে এটিই বেক্সিমকোর প্রথম যৌথ উদ্যোগ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সপ্তমবারের মতো ন্যাশনাল এক্সপোর্ট ট্রফি (গোল্ড) অর্জন করে। ২০২০ সালে কভিড-১৯ রেসপন্সের জন্য CPhI অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। কভিড-১৯ চিকিৎসার ব্রেক থ্রু ওষুধগুলোর জেনেরিক ভার্সন বিশ্বের প্রথম বেক্সিমকো ফার্মাই উৎপাদন করে। ২০২১ সালে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস জিতে নেয় বিশ্বের অন্যতম গৌরবময় পুরস্কার গ্লোবাল জেনেরিকস অ্যান্ড বায়োসিমিলারস অ্যাওয়ার্ড।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের স্বীকৃত অনেক পণ্য আপনাদের রয়েছে। এসব দেশের বাজারে আপনাদের অবস্থান কেমন?
প্রাথমিকভাবে দুটি ধাপ; একটি হচ্ছে অ্যাক্রেডিটেশন, অন্যটি প্রডাক্ট অ্যাপ্রুভাল। তারপর আমরা পণ্য নিয়ে বাজারে যেতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রই হচ্ছে ওষুধের সবচেয়ে বড় বাজার। বিশ্বের ৪৮ শতাংশ মার্কেট শেয়ার হচ্ছে তাদের। তারপর ইউরোপিয়ান দেশগুলো। এর মধ্যেই আমরা আন্তর্জাতিক বড় বড় বাজারে অ্যাক্রেডিটেশন পেয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রে আমরা রফতানি শুরু করেছি ২০১৬ সাল থেকে। তবে সেখানে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। আমাদের দেশে ১৫০-১৬০টি কোম্পানি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। ভারত থেকে ৩০০টার বেশি কোম্পানি ওষুধ খাতে প্রতিযোগিতা করছে। বাজার কিন্তু অনেক বড়। বাংলাদেশে আমরা যেভাবে প্রতিযোগিতা করি, যুক্তরাষ্ট্রে বা অন্য দেশে সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিজেদের ওষুধের প্রমোশন করছি। তিনি প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন ওষুধ লিখছেন, এভাবে হচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ৯০ শতাংশই দুই বা তিনটি ফার্মাসিউটিক্যালস চেইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত। এখন দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমি একটি পণ্য নিয়ে গেলাম। দেখা গেল সেখানে অন্তত ১৫-২০টি কোম্পানি একই পণ্য নিয়ে আগে থেকেই কাজ করছে। ফলে দাম একটি বড় বিষয় তখন। এটি অন্য আন্তর্জাতিক বাজারগুলোয়ও হয়। মূলত বড় ফার্মাসি চেইনগুলোর সঙ্গে আমাদের ব্যবসাটা করতে হয়। কিছুদিন আগেও আমরা শিখছিলাম, কীভাবে এ বাজারগুলোয় আমরা নিজেদের ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য নিয়ে ব্যবসা করতে পারি। এ বাজারগুলোয় আমরা নতুন। কিন্তু ধীরে ধীরে সেখানে আমাদের খুব ভালো উন্নতি হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার বাজারে গ্যাস্ট্রিক এবং অস্টিওআর্থ্রাইটিস ওষুধ ভালো প্রবৃদ্ধি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে বেক্সিমকো। আমাদের এখনো এ মার্কেটগুলোয় অনেক পণ্য নেই। বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে, আমরা ৩৫০-৪০০ পণ্য নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে শুধু আটটি, অস্ট্রেলিয়ায় পাঁচটি পণ্য নিয়ে কাজ করছি। আমরা যত বেশি পণ্য নিয়ে কাজ করতে পারব তত বেশি আন্তর্জাতিক বাজারগুলোয় নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারব। এজন্য একটু সময় লাগবে।
বেক্সিমকো ফার্মা বাংলাদেশে যত পণ্য নিয়ে কাজ করছে, তার সবই কি উচ্চ প্রযুক্তির? তাছাড়া আপনাদের এসব পণ্যের বিশেষত্ব কী?
বেশিরভাগ কোম্পানি ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা সিরাপ—এসব পণ্য তৈরি করতে পারে। কিন্তু উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বেক্সিমকো ফার্মা বাংলাদেশে পাইওনিয়ার। দেশে ইনহেলার ডোসেজ নিয়ে আসছিল নব্বইয়ের দশকে। এভাবে নেজাল স্প্রে, সাপোজিটরি নিয়ে আসে। স্থানীয় বাজারে যদি আমাদের পণ্যগুলো দেখেন, ওরাল সলিড ডোসেজের মধ্যেও আমরা প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য নিয়ে আসার চেষ্টা করি। এর বাইরেও উচ্চ প্রযুক্তির যেগুলো দেখা যায়—ইনহেলেশন অ্যারোসল, নেজাল স্প্রে, অপথালমিক, বায়োসিমিলার পণ্যগুলোর একটা অবস্থান আমরা তৈরি করতে পেরেছি বাংলাদেশের বাজারে। আন্তর্জাতিক বাজারেও আমাদের এ উচ্চ প্রযুক্তির পণ্যগুলোই বড় একটি পোর্টফোলিও।
বিশ্বের ১৬০টি দেশে ওষুধ রফতানি করলেও আমরা এখনো যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ বা অস্ট্রেলিয়ার বাজারে নিজেদের কোনো অবস্থান তৈরি করতে পারিনি। এখানে আসলে উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতাগুলো কী?
আমরা জেনেরিক মার্কেটে অপারেট করি, ইনোভেটিভ পণ্যের বাজারে এখনো অপারেট করি না। গ্লোবালি এ জেনারিক মার্কেটের আকার ৩১৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মার্কেট শেয়ার ২৮ শতাংশ। বিশ্বের আটটি বড় জেনেরিক কোম্পানির মধ্যে পাঁচটি হচ্ছে ইউরোপের, দুটি এশিয়ার, আরেকটি যুক্তরাষ্ট্রের। একটা মার্কেটের ডাইন্যামিকস থাকে একেক রকম। বাংলাদেশ এরই মধ্যে ১৬০টি দেশে ওষুধ রফতানি করছে। কিন্তু আমাদের রফতানি আয়ের বেশির ভাগ এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আসছে। আমাদের দেশে আমরা যেভাবে ওষুধ বিক্রি করি, এ অঞ্চল দুটিতেও কিন্তু প্রায় একই। যেমন আমরা যদি কেনিয়া, মিয়ানমার বা নেপালের কথা বলি, এ উপমহাদেশে ওষুধগুলো আমাদের দেশের মতোই বাজারজাত করা হয়। তবে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার বাজার ব্যবস্থা ভিন্ন। এ মার্কেটগুলো ফার্মেসি চেইন বা বিপণনকারীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ওইসব দেশে বীমা আছে। ডাক্তার একটা ব্যবস্থাপত্র দিল এবং যে ফার্মেসি থেকে জেনেরিক নামে যেটা থাকবে তাই দেবে। আমরা কিন্তু ব্র্যান্ড নামে বিক্রি করছি। এখানে আমরা প্যারাসিটামল নাপা নামে দিচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু উন্নত দেশগুলোয় আমাকে জেনেরিক নামে বিক্রি করতে হয়। সেখানে যে ফার্মেসি যে কোম্পানির ওষুধটা রাখে সেটাই তারা ডিসপেন্স করে। চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে আমার ফার্মেসি চিনে ওষুধটা দেয়া। এখানে সমস্যা হচ্ছে উন্নত দেশের বাজারে আমাদের পণ্য অনেক কম। তবে ভালো ব্যাপার হচ্ছে, এরই মধ্যে পাঁচটা কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইউএসএফডিএ) অনুমোদন পেয়েছে। সবাই যদি ২০-৩০টা বা ৪০টা পণ্যের রেজিস্ট্রেশন করতে পারি, তাহলে দেশ হিসেবে আমাদের একটা বড় বাস্কেট তৈরি হবে।
দ্বিতীয়ত, দামের প্রতিযোগিতা। কারণ ভারত থেকে যাচ্ছে, কোরিয়া থেকে যাচ্ছে, জাপান থেকে যাচ্ছে, ইউরোপ থেকে যাচ্ছে। আমরা এপিআই নিজেরা বানাচ্ছি না। এখন কিন্তু বড় কোম্পানিগুলোও যুক্তরাষ্ট্রে স্ট্রাগল করছে। দেশটিতে জেনেরিক পণ্যের দাম প্রায় ৪ শতাংশ কমে গেছে। ভ্যালুতে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বেশি বড় হয়নি। ইউনিটে পাঁচ বছরে প্রায় ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এখন তারা একই ওষুধ কম দামে চাইবে।
বিশ্বের যেসব সংস্থার অনুমোদন পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ, সেসব সংস্থায় আমাদের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কিছু পণ্যের অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু পরিসর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আমাদের সীমাবদ্ধতা কোথায়?
আমাদের দেশে ৪০ বছর ধরেই কিন্তু ফার্মাসিউটিক্যালস খাতে প্রবৃদ্ধিটা আসছে। ফর্মুলেশন ক্যাপাবিলিটি খুব ভালোভাবে তৈরি করতে পেরেছি। যে জিনিসগুলো বাইরে থেকে দেখে সেটা হচ্ছে—জিএমপি (গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাকটিস) বা সিজিএমপি (কারেন্ট গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাকটিস)। আমরা সাধারণত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সিজিএমপি মেনে কাজ করি। বেশির ভাগ দেশ সেটিই করে। যখন জিএমপির কথা বলা হয়, তখন কথা হয় প্রক্রিয়াটা নিয়ে, ডকুমেন্টেশন নিয়ে, ডাটা ইন্টিগ্রিটি বা শুদ্ধতা নিয়ে। জিএমপি অনুমোদনের প্রক্রিয়াটা হচ্ছে পুরো মানকে অনুসরণ করা। সেটা শুধু যেদিন অডিট হচ্ছে শুধু সেটা না। এটা প্রতিদিনের কার্যক্রম। এখন আমাদের এখানে রেগুলেটেড মার্কেটে অনুমোদন লাভের জন্য বেশ কয়েকটি কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে, নতুন করে ফ্যাসিলিটি তৈরি করেছে।
আপনাদের কোন কোন ওষুধ ভালো এবং বিশ্ব বাজারে অবস্থান তৈরি করবে?
আসলে বাজার অনুযায়ী ভিন্নতা রয়েছে। একেক দেশের পণ্যের চাহিদা একেক রকম। আমাদের ইনহেলেশন অ্যারোসল বিশ্বের অনেক বাজারে বেশ ভালো করছে।
কাঁচামাল আমদানিতে উল্লেখযোগ্য সমস্যা কী রয়েছে, যেটা রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে?
আমাদের প্রতিযোগিতার একটা দুর্বলতা হচ্ছে অপ্রতুল ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ। এপিআই আমদানি করতে হচ্ছে, তারপর ফর্মুলেশন রফতানি করতে হচ্ছে। কিছু এপিআই অবশ্য এখানে বানানো হচ্ছে। সেটি ১০ শতাংশ। কয়েকটা কোম্পানি এরই মধ্যে এপিআই বানানো শুরু করেছে। অন্যদিকে শুধু বাংলাদেশ না, প্রত্যেকটা দেশ কিন্তু একটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন এপিআই আমদানি করে ওষুধ রফতানি করতে সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু দাম বেড়ে গেছে। উৎপাদন খরচও বাড়ছে। অন্যদিকে বড় বাজারগুলোয় পণ্যের দাম কমছে। এই একটা চ্যালেঞ্জ আমাদের নিতে হচ্ছে।
ওষুধ শিল্পে এপিআই পার্কের ভূমিকা আসলে কেমন? এটি রফতানিতে কী ভূমিকা রাখতে পারবে?
এপিআই পার্ক নিয়ে এ মুহূর্তে আমরা যে স্বপ্ন দেখছি, তা কাজে লাগিয়ে ওষুধ শিল্পকে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের রফতানি খাত হিসেবে তৈরি করব। কিছু পদক্ষেপ নিলে এটি সম্ভব। বিশ্বের শীর্ষ জেনেরিক ১০টি কোম্পানির মধ্যে চারটি কিন্তু ভারতের। ১০-১৫ বছর আগে কিন্তু তারা এ তালিকায় ছিল না। এখানে অবশ্যই এপিআই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তাদের জন্য বেশি সহায়ক হয়েছে। এপিআইয়ের প্রথম ব্যাপার হচ্ছে দাম ও দ্বিতীয়ত, সঠিক সময়ে বাজারে দেয়া।
এপিআই পার্কে আসতে কোম্পানিগুলোর কি কোনো অনীহা আছে?
কোম্পানিগুলো আসতে চায় না বিষয়টা এমন নয়। কিছুদিন আগে কভিড-১৯ গেল। সে সময় একটা সংকট ছিল। এরপর আমাদের এখানে ইউটিলিটি (পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস) সমস্যা। সবাই সেখানে আসতে চায়। কিন্তু পর্যাপ্ত ইউটিলিটি সুবিধা তো থাকতে হবে। ফলে একটু দেরি হচ্ছে। এপিআইয়ের প্রয়োজনীয় ইন্টারমিডিয়েট ও সলভেন্ট যেগুলো লাগে, সেগুলো বাংলাদেশে তৈরি হয় না। এটি আবার সফল হবে না যদি আমরা কিছু পদক্ষেপ এখনই না নিই। ফলে সবকিছু আমদানি করে এনে এটিকে সফল করাটা কঠিন।
দেশীয় ফার্মাসিউটিক্যালসে গবেষণা ও উন্নয়ন সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? তাছাড়া নতুন মলিকুল তৈরিতে আর কত সময় লাগবে? আমরা একটি জেনেরিক ফার্মা ইন্ডাস্ট্রি। মলিকুল উদ্ভাবন কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। একটা জিনিস আমরা ভুল করি, যত রকম উদ্ভাবন হচ্ছে সেটি আমরা মনে করি ফার্মা কোম্পানি করছে। কথাটা ঠিক না। ৯০ ভাগ উদ্ভাবন কিন্তু কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান করছে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশী কোম্পানিগুলো আমাদের ল্যাবে যেটা করছি কীভাবে মানটা আরো ভালো করা যায়, খরচ কমানো যায় ইত্যাদি। এখন বেসিক গবেষণা কোনো ফার্মা কোম্পানি করছে না। এটি হয়তো কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি আমাদের কাছে আসে, আমরা এ কোলাবরেশনে (সহযোগিতা) যেতে চাই, তাহলে আমরা অবশ্যই ফান্ডিং করব। আবার ইন্ডিয়ান বা জাপান ও কোরিয়ান কোম্পানিগুলো যেটা করছে, যে পণ্যটি আছে সেটিকে কীভাবে আরো ভালো করা যায়। এটিও কিন্তু একটা গবেষণা। শীর্ষ কোম্পানিগুলো কিন্তু এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের এ ধরনের গবেষণায় আসতে হবে। ভ্যালু অ্যাড (মান সংযোজন) করতে পারলে আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারব। আমরা এখন যেখানে এসছি, সেখান থেকে যদি আরো ভালো করতে চাই, তাহলে মৌলিক কিছু গবেষণা করতে হবে। সেটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কোলাবরেশন করেই করতে হবে। কারণ পুরোপুরি একা করা কঠিন।